খেলার পরিসংখ্যানের দিকে একবার তাকালেই বোঝা যায়, ফ্রান্সের চেয়ে কতটা ভালো খেলেছে বেলজিয়াম। বল দখলের লড়াইয়ে ৬৪ ভাগ ছিল বেলজিয়ামের কাছে। মাত্র ৩৬ ভাগ ফ্রান্সের দখলে। ৫৯৪টি পাস দিয়েছিল বেলজিকরা। বিপরীতে ফ্রান্স পাস দিয়েছে মাত্র ৩৪৫টি। যদিও বেলজিয়াম গোল লক্ষ্যে শট নিয়েছিল কেবল ৮টি। বিপরীতে ফ্রান্স শট নিয়েছে ১৩টি।
এই পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে মাঠের খেলায় কতটা পার্থক্য ছিল ফ্রান্স এবং বেলজিয়ামের খেলার মধ্যে। কিন্তু আফসোস খেলায় বল দখলের লড়াই দিয়ে যদি জয়-পরাজয় নির্ধারণ করা হতো, তাহলে তো কথাই ছিল না। কিন্তু ফুটবল মানে হলো গোলের খেলা। গোলই শেষ কথা। আপনি শতভাগ মাঠে প্রভাব বিস্তার করেছেন নাকি ১০ ভাগ করেছেন, নাকি ১০টা শট বেশি নিয়েছেন- সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হলো গোল। যে গোল করবে, সেই জয়ী।
সেন্ট পিটার্সবার্গ স্টেডিয়ামে ফ্রান্স বনাম বেলজিয়ামের লড়াইয়ে ১-০ গোলে জয় নিয়ে রাশিয়া বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠে গেল ১৯৯৮ সালের চ্যাম্পিয়নরা। বার্সেলোনায় খেলা ডিফেন্ডার স্যামুয়েল উমতিতির অসাধারণ এক হেডের গোলেই জয় নিয়ে মাঠ ছাড়লো ফরাসিরা।
সেমিফাইনালের জমজমাট এই লড়াই শেষ। শ্বাসরুদ্ধকর লড়াই শেষে শেষ হাসি হাসলো আন্তোনিও গ্রিজম্যান এবং কাইলিয়ান এমবাপেরা। কিন্তু তবুও তো কথা থেকে যায়। অনেক বিচার হবে, বিশ্লেষণ হবে। কারণ খোঁজা হবে, এত ভালো খেলেও কেন বেলজিয়াম হেরে গেল? কেন একের পর এক আক্রমণ পরিচালনা করেও গোল আদায় করতে পারলো না?
কারণটা খুবই সহজ। ফ্রান্সের ইস্পাত-কঠিন ডিফেন্স। বেলজিয়ামের তারকাভর্তি টাইটানিক ডুবে গেল ফ্রান্সের ‘লুকানো আইসবার্গ’ ডিফেন্সের সামনেই আটকে গেল বেলজিয়ামের বানের পানির মতো ধেয়ে আসা সব আক্রমণ।
ফ্রান্সের রক্ষণভাগের সেনানিরা খেলেন বিশ্বের নামকরা সব ক্লাবে। সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার রাফায়েল ভারানে রিয়াল মাদ্রিদের নিয়মিত একাদশের ডিফেন্ডার। স্যামুয়েল উমতিতি বার্সার ডিফেন্ডার। সঙ্গে দুই উইংয়ের ডিফেন্ডার বেঞ্জামিন পাভার্দ, লুকাস হার্নান্দেজ। ব্লাইজ মাতুইদি ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার। বেলজিয়ামের আক্রমণগুলো ফ্রান্সের ডিফেন্সিভ থার্ডে ঠেকিয়ে দেয়ার কাজ সুন্দর করে সম্পন্ন করেছেন তিনি।
ফ্রান্সের মাঝমাঠের সবচেয়ে বড় কান্ডারি ছিলেন এনগোলা কান্তে। ইডেন হ্যাজার্ডদের কাছ থেকে মাঝ মাঠ থেকেই বল কেড়ে নিয়ে গ্রিজম্যান, জিরু কিংবা এমবাপেদের জন্য বল তৈরি করে দেয়ার কাজটি করেছেন কান্তে নিজেই। মিডে ছিলেন পল পগবাও। ক্লাব পর্যায়ে তার খেলা নিয়ে অনেক প্রশ্ন থাকতে পারে। কিন্তু বিশ্বকাপে এসে পুরোপুরি নিজেকে ঢেলে দিয়েছেন পগবা।
তবে, একজনের কথা না বললে অপরাধই হয়ে যাবে। বেলজিয়ামের সমস্ত আক্রমণ ফ্রান্সের ডিফেন্স ভেদ করে সামনে এগিয়ে এলেও- হ্যাজার্ড, ডি ব্রুয়েন, ফেলাইনি কিংবা লুকাকুরা পোস্টে শট নিলেও একজন ছিলেন পুরোপরি চীনের মহাপ্রাচীরের মতো। তিনি ফ্রান্সের গোলরক্ষক হুগো লরিস।
ফ্রান্সের অধিনায়কও বটে তিনি। দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন মাঠে। পারফরম্যান্সেও। ইডেন হ্যাজার্ড, ডি ব্রুয়েন কিংবা ফেলাইনিরা একের পর এক শট নিলেও সব এসে থমকে যাচ্ছিল পোস্টে লরিসের সামনে এসে। তাকে ফাঁকি দিয়ে একটি পিঁপড়াও ঢোকার সাধ্য ছিল না। ঝাঁপিয়ে পড়ে অসাধারণ সব সেভ করেছেন। নিশ্চিত গোল থেকে বাঁচিয়েছেন দলকে। স্যামুয়েল উমতিতির গোলের চেয়েও হুগো লরিসের গোল বাঁচানো কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, এই ম্যাচে। মজার বিষয় হলো, ডিফেন্ডার উমতিতিই কিন্তু গোল করে জেতালেন ফ্রান্সকে।
সবচেয়ে বড় কথা, বেলজিয়ামের মতো সম্ভাবনাময়ী একটি দলকে বিদায় করে দিয়ে ফাইনালে ফ্রান্সের জায়গা করে নেয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অবদান নিশ্চিত অর্থেই ডিফেন্সের কৃতিত্ব। কোচ দিদিয়ের দেশম জানতেন, বেলজিয়াম আক্রমণে আসবে। প্রচণ্ড গতি দিয়ে তারা চেষ্টা করবে ফ্রান্সের ডিফেন্স ভাঙতে। ব্রাজিলকে যেভাবে বেলজিকরা হারিয়েছিল, তেমন গতি দিয়ে ফ্রান্সকেও হারিয়ে দিতে পারে।
এ কারণে দেশম, তার গেম প্ল্যানই সাজিয়েছিলেন পুরোপুরি ডিফেন্সকে কেন্দ্র করে। যে কারণে দেখা গেছে কখনও কখনও অলিভিয়ের জিরু কিংবা পল পগবার মতো খেলোয়াড়কেও দেখা গেছে ডিফেন্সে নেমে এসে দলকে গোল থেকে বাঁচাতে। ডিফেন্সই বলতে গেলে ফ্রান্সকে তুলে দিয়েছে ফাইনালে এবং হয়তো বা শিরোপাটাও দ্বিতীয়বারেরমত এনে দেবে।